ইহরাম কখন এবং কোথায় বাঁধবেন? ইহরামের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং কোন হাজী কত সময় ইহরাম অবস্থায় থাকবেন?

ইহরাম কখন এবং কোথায় বাঁধবেন?

সরাসরি মক্কায় গমন করলে

তিন প্রকার হাজীগণই যদি সরাসরি মক্কা শরীফে যান তাহলে তাঁকে নিজ বাড়ী/হাজী ক্যাম্প/বিমানবন্দর অথবা বিমানের ভিতরে অর্থাৎ বিমান ‘ইয়ালামলাম’ মীকাত অতিক্রম করার পূর্বেই ইহরাম বাঁধতে হবে। মীকাত হতে ইহরাম বাঁধা সুন্নাত। বিমানের ভিতর ইহরামের কাপড় পরা, উজু করা এবং নামাজ পড়া খুবই কষ্টকর। সুতরাং নিয়ত ও তালবিয়াহ পাঠ করা ব্যতীত ইহরামের অন্যান্য কাজগুলো সম্পন্ন করে বিমানে আরোহণ করবেন। 

তাহলে বিমানের পাইলট মীকাত অতিক্রমের পূর্বে ঘোষণা দিলে তখন সিটে বসেই নিয়ত ও তালবিয়াহ পাঠ করলেই ইহরাম বাঁধা হয়ে যাবে। ইহরাম ব্যতীত মীকাত অতিক্রম করলে দম দিতে হবে।

সরাসরি মক্কায়

খ। সরাসরি মক্কায়, তারপর মদীনায়, অতঃপর মক্কায় আসলে এক্ষেত্রে তামাত্তু হজ্বকারীগণ ইহরাম বেঁধে মক্কায় গিয়ে উমরাহ্ শেষ করে ইহরাম মুক্ত হয়ে যাবেন। পরবর্তীতে মদীনা শরীফ থেকে মক্কায় আসার সময় পুনরায় উমরাহ্র নিয়তে ইহরাম বেঁধে এসে একটি নফল উমরাহ্ করে ইহরাম মুক্ত হবেন। এরপর ৭/৮ যিলহজ্ব তারিখে হজ্বের নিয়তে ইহরাম বাঁধবেন। 

এক্ষেত্রে একজন হাজীকে ৩ বার ইহরাম বাঁধতে হবে। ক্বিরান হজ্বকারীগণ এক ইহরামে মক্কামদীনা সফর করে হজ্বের কুরবানি শেষ করে মাথা মুন্ডিয়ে ইহরাম মুক্ত হবেন। এক্ষেত্রে একজন হাজীকে ১ বার ইহরাম বাঁধতে হবে।

ইফরাদ হজ্বকারীগণ মক্কা-মদীনা যেখানেই প্রথম যান, মীকাত অতিক্রম করার পূর্বেই ইহরাম বাঁধতে হবে এবং ১০ যিলহজ্ব তারিখে বড় জামারায় কংকর নিক্ষেপ করে মাথা মুন্ডিয়ে ইহরাম মুক্ত হবে। এক্ষেত্রে একজন হাজীকে ১ বার ইহরাম বাঁধতে হবে।

যদি কোনো তামাত্তু হজ্বকারী মদীনা শরীফ থেকে হজ্বের ২/১ দিন আগে মক্কা শরীফে আসেন তাহলে তিনি হজ্বের নিয়তেও ইহরাম বেঁধে আসতে পারবেন। সেক্ষেত্রে তিনি মক্কায় পৌঁছে আর ইহরাম খুলতে পারবেন না। এ ইহরামেই হজ্ব করবেন।

সরাসরি মদীনা শরীফে গমন করলে

গ। সরাসরি মদীনা শরীফে গমন করলেঃ যাঁরা বাংলাদেশ থেকে সরাসরি মদীনা শরীফ যাবেন তাঁদেরকে সাধারণ পোশাকে মদীনায় যেতে হবে। মদীনা যিয়ারত শেষ করে মক্কায় আসার সময় ‘যুলহুলাইফা’ নামক মীকাত থেকে অথবা মদীনার নিজ নিজ হোটেল থেকে ইহরাম বাঁধতে হবে।

মক্কায় হারাম এলাকায় অবস্থানকারীগণ কোথায় ইহরাম বাঁধবেন

ঘ। মক্কায় হারাম এলাকায় অবস্থানকারীগণ কোথায় ইহরাম বাঁধবেনঃ এ ব্যাপারে মীকাত অধ্যায়ের পোষ্টে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে তা দেখুন।

হজ্ব ফ্লাইটে বিড়ম্বনার আশংকা থাকলে কী করবেন

ঙ। হজ্ব ফ্লাইটে বিড়ম্বনার আশংকা থাকলে কী করবেনঃ প্রতি বছর আমাদের দেশে হজ্ব ফ্লাইট বিড়ম্বনা হয়ে থাকে এবং হাজীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সুতরাং এমন আশংকা দেখা দিলে হাজীগণ হজ্ব/উমরাহ্ করার জন্য ইহরাম বাঁধার ফরজ কাজ দুটি অর্থাৎ নিয়ত ও তালবিয়াহ পড়া ছাড়া, ইহরাম বাঁধার সকল সুন্নাত কাজগুলো সম্পন্ন করে বিমান বন্দরে যাবেন।

তাহলে ফ্লাইট দীর্ঘ সময় বিলম্ব হলে অথবা বাতিল হলে ইহরামের পোশাক খুলে ফেলা জায়েয হবে। কারণ শুধু ইহরামের পোশাক পরলেই এক ব্যক্তি ‘মুহরিম’ হয় না অর্থাৎ ইহরাম বাঁধা সম্পন্ন হয় না এবং তাঁর উপর ইহরামের নিষেধাজ্ঞাগুলোও বর্তায় না। এক্ষেত্রে নতুন তারিখে/সময়ে পুনরায় পূর্বে বর্ণিত সুন্নাত নিয়মে ইহরাম বাঁধতে হবে।

ইহরামের গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ

ক। আমরা সকলেই ইহরাম বাঁধা বা ইহরাম পরিধান করা কথাটি বলে থাকি। ইহরাম কী- এটা আমাদের খুব পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে। সাধারণভাবে পুরুষদের জন্য আমরা দু’টুকরা সাদা কাপড় পরাকেই ইহরাম বুঝে থাকি। সাদা পোশাক পরতে হবে, এ কথা ঠিক, কিন্তু এটা হলো বাহ্যিক সাদা পোশাক। আসলে অন্তরকে সাদা পোশাক পরাতে হবে। সাদা পোশাক পরে নিজের পরিচিত জীবন ও জগৎকে পরিত্যাগ করে নতুন লেবাসে নতুন এক জগতে প্রবেশ করতে হবে। তাহলেই ইহরাম ধারণ করা সার্থক হবে।

খ। আমরা যখন ইহরামের সাদা পোশাক পরিধান করি, তখন মনের অনুভূতি কেমন হওয়া উচিত? এটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য পোশাক বদলের মতো একটি ব্যাপার নয়। ‘এ পোশাক বরং নিজের জীবনকে, নিজের আত্মাকে বদলানোর পোশাক। এ পোশাক কেবল ইহরাম অবস্থায় থাকার সময় নিজেকে বদলানোর জন্য নয়, বরং এ পোশাক একজন মানুষের সারা জীবনের সব কিছু বদল করে দেয়ার পোশাক’। 

আমরা যদিও হজ্ব বা উমরাহ্ করার জন্য ইহরামের শুভ্র পোশাক পরিধান করি এবং হজ্ব বা উমরাহ্ শেষে এ পোশাক খুলে ফেলি কিন্তু ইহরামের শুভ্রতা ও পবিত্রতা সর্বোক্ষণের জন্য যদি নিজের জীবনে ধারণ করে রাখতে পারি, তাহলেই আমরা হবো কামিয়াব।

গ। যারা সত্যিকার অর্থে ইহরাম পরিধান করেন, তাঁরা শরীয়তের বিধান মেনে ইহরামের লেবাস তো খুলে ফেলেন, কিন্তু মৃত্যু পর্যন্ত ইহরামের শিক্ষা তাঁরা ত্যাগ করেন না এবং ইহরামের আবরণ থেকে কখনও বের হয়েও আসেন না। তাঁদের ইহরাম আসলে ইব্রাহিমী ইহরামের ছায়া এবং মুহাম্মাদী ইহরামের প্রতিচ্ছায়া। 

আল্লহ্ যেন সেই ইহরামের ছায়া/আলো আমাদের সারা জীবনের ইবাদাতে, বন্দেগীতে, মুআশারায়, মুআমালায় তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে অব্যাহত রাখেন। হে আল্লহ্! তুমি কবুল করো আমাদের ইহরাম। মহিলাদের জন্যও সাদা পোশাক পরা জরুরী নয়, তবে মার্জিত পোশাক পরা বাঞ্ছনীয়।

কোন্ হাজী কত সময় ইহরাম অবস্থায় থাকবেন

কোন্ হাজী কত সময় ইহরাম অবস্থায় থাকবেনঃ

ক। তামাত্তু হজ্বকারীঃ নিজ বাড়ী/হাজী ক্যাম্প/ ঢাকা বিমান বন্দর থেকে বা উড়োজাহাজের ভিতরে মীকাত (ইয়ালাম লাম) অতিক্রম করার পূর্বে ইহরাম বাঁধবেন এবং পবিত্র মক্কায় পৌঁছে প্রথমে উমরাহ্ শেষ করে ইহরাম মুক্ত হবেন। পরবর্তীতে একজন হাজীকে ৭/৮ যিলহজ্ব থেকে ১০/১১/১২ যিলহজ্ব পর্যন্ত অর্থাৎ কুরবানি করে মাথা মুন্ডন না করা পর্যন্ত ইহরাম থাকতে হয়। মহিলা হাজীদের জন্য একই নিয়ম।

খ। ক্বিরাণ ও ইফরাদ হাজীদের পুরা সফরে একবারই ইহরাম বাঁধতে হয়। কারণ ক্বিরাণ ও ইফরাদ হজ্বকারীগণকে সফরের শুরুতে মীকাত থেকে ইহ্রাম বাঁধতে হয় এবং ১০/১১/১২ যিলহজ্ব তারিখে হজ্বের কুরবানি ও মাথা মুন্ডন না করা পর্যন্ত ইহরাম অবস্থাতেই থাকতে হয়। তাঁরা জেদ্দা হয়ে প্রথমে মদীনা সফর করলেও ইহরামেই থাকতে হয়। 

যদি কেউ প্লেনে সরাসরি মদীনা যান অর্থাৎ যদি পথে কোনো মীকাত অতিক্রম না করেন তাহলে তাকে মদীনা থেকে মক্কা যাওয়ার সময় হোটেলের রুম থেকে অথবা যুল্হুলাইফা মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। এক্ষেত্রে একজন হাজীকে একবারই ইহরাম বাঁধতে হয়, এবং দীর্ঘ সময় ইহরামের বাধ্য-বাধকতার মধ্যে থাকতে হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url