হজ্ব ও উমরাহর সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু সংজ্ঞা ও পরিভাষার পরিচিতি

হজ্ব ও উমরাহর সাথে সংশ্লিষ্ট সংজ্ঞা/পরিভাষা 

পবিত্র হজ্ব বা উমরাহর কথা বলতে গেলেই বা হজ্বের প্রশিক্ষণ দিতে/নিতে গেলেই এবং হজ্ব বা উমরাহ্ পালন করতে গেলেই কতগুলো সংজ্ঞা/পরিভাষার সম্মুখীন হতে হয়। সে সব সংজ্ঞা/পরিভাষার সাথে পরিচিত হওয়া এবং সেগুলো সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা থাকা হাজীদের জন্য জরুরী। তাই, এ বই এর শুরুতেই সেগুলোর পরিচিতি এবং সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ লিখে দিলাম।

কা’বা ঘর / বাইতুল্লাহ - ১

এটি মক্কা মুকাররামায় মাসজিদুল হারামের মাঝখানে দুনিয়ার সর্বপ্রথম ইবাদাত ঘর। কা’বা ঘরের অপর নাম বাইতুল্লাহ, অর্থ আল্লহর ঘর। এ ঘরকে ‘আল-বাইতুল হারাম’, ‘আলবাইতুল আতীক’ও বলা হয়। এ ঘরটি পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং এ ঘরটি সর্বপ্রথম ফেরেশতা দ্বারা নির্মিত। এটি মুসলমানদের কিবলা।

নিশ্চয়ই গোটা মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘরটি বানিয়ে রাখা হয়েছিল, তা ছিল বাক্কায় (মক্কা নগরীতে)। এ ঘরটি অত্যন্ত কল্যাণময়, বরকতময় এবং বিশ্ব জগতের দিশারী করে বানানো হয়েছিল। এখানে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ, ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর স্থান, যে এখানে প্রবেশ করবে সে (দুনিয়া-আখেরাত) উভয় স্থানেই নিরাপদ হয়ে যাবে (সূরা আলে- ইমরান, আয়াত ৯৬ ও ৯৭)। 

এ ঘরটি সপ্তম আসমানে ফিরিশতাদের ইবাদাত ঘর ‘বাইতুল মামুরের’ সোজা নিচে অবস্থিত। মুসলমানগণ কা’বা ঘরকে ইবাদাত করেন না বরং এ ঘরের মালিকের অর্থাৎ আল্লহর ইবাদাত করেন। কা’বা ঘর মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক। আল্লহ্ এ ঘরকে মানবজাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদস্থল হিসেবে ঘোষণা করেছেন (সূরাঃ বাকারা, আয়াতঃ ১২৫ থেকে ১২৯)। 

আমাদের আদি পিতা আদম (আঃ) সহ সকল নবী পয়গম্বরগণ এ ঘরের তওয়াফ করেছেন। অতএব, এ ঘরকে তওয়াফ করা মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক। কালো গিলাফে ঢাকা আল্লহর এ ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকাও ইবাদাত।

নামাজ পড়া, রোজা রাখা, তওয়াফ করা যেমন ইবাদাত, তেমনি আদব ও মহব্বতের সাথে আল্লহর ঘরের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকাও ইবাদাত। একটি ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকা ইবাদাত, এটি শুধু আল্লহর ঘরের জন্যই প্রযোজ্য। কী আছে এ ঘরে ! কী আছে এ কালো গিলাফের আবরণে ? দেখতে সাধারণ ঘর অথচ এতো অসাধারণ। কী কারণে এ ঘরের এতো মর্যাদা ও গরিমা ? কারণ এটি আল্লহর ঘর- এটার উপর সর্বক্ষণ আল্লহর খাস রহমতো বর্ষিত হচ্ছে। 

এটা মানুষের নিরাপত্তার স্থল। এ ঘরের দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়, হৃদয়-মন নূরের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে যায়, অশান্ত হৃদয় শীতল হয়ে যায়। এ ঘরের সৌন্দর্য চিরদিন অম্লান থাকবে। এ ঘরের জ্যোতির্ময়তা মানুষের হৃদয়কে চিরদিন উদ্ভাসিত করবে। 

এ ঘরের দিকে তাকিয়ে কারো তৃপ্তি মেটে নাআকর্ষণ কমে না। সুতরাং এ ঘরের চতুর্দিক থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে এ ঘরের অলৌকিকত্ব ও সৌন্দর্য অবলোকন করে নিজেকে সিক্ত করুন ও নিজের সকল গ্লানি ধুয়ে মুছে পাপ মুক্ত হউন। বাইতুল্লাহর ইতিকথা এখানে লিখে শেষ করা যাবে না। আপনারা এ ঘরের ইতিহাস পড়ুন।

বাইতুল মামুর - ২ 

সপ্তম আকাশে অবস্থিত ফিরিশতাদের কা’বাকে বাইতুল মামুর বলে। এটা দুনিয়ার কা’বার ঠিক উপরে অবস্থিত। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে প্রমাণ আছে যে, মিরাজের রাত্রিতে রসূল (সঃ)-কে বাইতুল মামুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং সেখানে পৌঁছে হুজুর (সঃ) ইব্রাহীম (আঃ)-কে বাইতুল মামুরের প্রাচীরে হেলান দিয়ে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন। বাইতুল মামুরে প্রত্যহ ৭০ হাজার ফিরিশতা ইবাদাতের জন্য প্রবেশ করেন। এর পর তাঁদের পুনরায় বাইতুল মামুরে প্রবেশ করার পালা আসে না। প্রত্যহ নতুন ফিরিশতাদের পালা আসে (সূত্রঃ ইবনে কাসীর)।

মাসজিদুল হারাম - ৩ 

এটি মহা সম্মানিত ঐতিহাসিক মাসজিদ, যা পবিত্র কা’বা শরীফকে পরিবেষ্টন করে আছে। মাসজিদুল হারাম শুধু বিল্ডিংটুকু নয়, বরং বিল্ডিং এর চারদিকে যে স্থান পর্যন্ত এক জামাআ’তে নামাজ আদায় করা হয়, সে স্থানকে মাসজিদুল হারাম বলে। এ মাসজিদের কথা আল্লহ পবিত্র কুরআনের অনেক সূরার বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ করেছেন। 

বিশেষ করে সূরা বাকারার ১৪৪ নং আয়াতে আল্লহ্ রসূল (সঃ)-কে নির্দেশ করেছেন, ‘হে রসূল (সঃ), আমি আপনার বার বার আকাশের দিকে তাকানো লক্ষ্য করেছি, আমি আপনার মনের তামান্না (ইচ্ছা) সম্বন্ধে অবগত। অতএব আপনি মাস্জিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরান।’ আল্লহর এ নির্দেশেই বুঝা যায় মাসজিদুল হারামের গুরুত্ব ও তাৎপর্য। উক্ত সূরার ১৪২, ১৪৩, ১৪৪, ১৪৯ ও ১৫০ নং আয়াতেও আল্লহ্ মাসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরাতে বলেছেন। 

সূরা তাওবা-এর ২৮ নং আয়াতে আল্লহ্ ঘোষণা দেন, ‘হে মুমিনগণ! মুশরিকরা তো অপবিত্র; সুতরাং এ বছরের (৮ম হিজরীর) পর থেকে তারা যেন মাসজিদুল হারামের নিকট না আসে।’ তাই মক্কা বিজয়ের পর রসূল (সঃ) আল্লহরই নির্দেশে সকল অমুসলমানদের জন্য মক্কায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেন, যা এখনো বলবৎ আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ হুকুম জারী থাকবে, ইন্শাআল্লহ। পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে আল্লহ মাসজিদুল হারামের কথা উল্লেখ করেছেন (সূরাঃ মায়িদাহ, আয়াতঃ ২, সূরা আনফাল, আয়াতঃ ৩৪, সূরাঃ তাওবা, আয়াতঃ ৭, ১৯, ২৮, সূরাঃ হাজ্ব আয়াতঃ ২৫ এবং সূরাঃ ফাত্হ, আয়াত ঃ ২৫ ও ২৭)। 

আত্মতৃপ্তির জন্য এসব আয়াতের তরজমা-তাফসীর পড়বেন। তাহলে মাসজিদুল হারামের গুরুত্ব বুঝবেন। যুগে যুগে মাসজিদুল হারামের সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে বড় সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এ কাজ শেষ হলে মাসজিদুল হারামে প্রায় ৪০ লক্ষ লোক একত্রে নামাজ আদায় করতে পারবেন। সৌদি সরকার ভবিষ্যতে আরও মহা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছেন, যা ইন্টারনেটে দেখা যায়।

ইহরাম - ৪

এটার শাব্দিক অর্থ কোনো বস্তু বা বিষয়কে ‘হারাম’ (নিষিদ্ধ) করা। উমরাহ্ বা হজ্ব পালনকারীগণ বিশেষ পোশাক পরিধান করার পর হজ্ব বা উমরাহর ‘নিয়ত করে তাল্বিয়াহ্’ পাঠ করলে তাঁর উপর স্বাভাবিক অবস্থায় হালাল ছিল, এমন অনেক বৈধ কাজ/বিষয় নিজের উপর হারাম হয়ে যায়, বিধায় ইহাকে ইহরাম বলে। ইহরাম অর্থ- হজ্ব বা উমরাহ্ করার উদ্দেশ্যে সুন্নাত তরীকায় কতগুলো নির্ধারিত আ’মল করে বিশেষ অবস্থা ধারণ করা। (বিস্তারিত ইহরাম অধ্যায়ের পোষ্ট দেখুন, রেফারেন্স)

তালবিয়াহ - ৫

এর অর্থ হজ্ব বা উমরাহ্ করার জন্য আল্লহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার ঘোষণা দেয়া। নির্ধারিত কতগুলো শব্দের মাধ্যমে এ ঘোষণা দিতে হয়। যেমন, ‘লাব্বাইকা আল্লহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা-শারীকা লাক।’ তালবিয়াহ পড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নেক আ’মল।

তালবিয়াহ্ ব্যতীত ইহরাম বাঁধা হয় না এবং ইহরাম ব্যতীত মী’কাত অতিক্রম করা যায় না। তালবিয়াহর শব্দগুলোর অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। তালবিয়াহ পড়ার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আল্লহর নিকট আত্মসমর্পণ করেন। 

রসূল (সঃ) বিদায় হজ্বের সময় যুল্হুলাইফা নামক স্থানে (মদীনার মীকাত) সাহাবাদেরকে নিয়ে জোরে জোরে তালবিয়াহ পড়েছেন। উচ্চস্বরে তালবিয়াহ পড়া সুন্নাত। তাই উচ্চস্বরে (তবে চিৎকার করে নয়) তালবিয়াহ্ পড়তে লজ্জা পাবেন না। মহিলারা নিচু স্বরে তালবিয়াহ পড়বেন। তালবিয়াহকে হজ্বের প্রাণও বলা হয়। উমরাহ্ ও হজ্ব করার সময় বহু হাজীদেরকে এ ব্যাপারে অমনোযোগী/গাফেল দেখা যায়।

মুহরিম - ৬

হজ্ব/উমরাহ্ করার জন্য ইহরাম বাঁধা ব্যক্তিকে ‘মুহরিম’ বলে।

মাহরাম - ৭

শরীয়তের বিধান অনুযায়ী কোনো মহিলাকে হজ্ব/উমরাহ্ করতে যাওয়ার জন্য পুরুষ সাথীকে মাহরাম বলে। মাহরাম ছাড়া কোনো মহিলার জন্য হজ্ব/উমরাহ্ করতে যাওয়া বৈধ/জায়েয নয়। যে সকল পুরুষ আত্মীয়ের সাথে মহিলাদের বিবাহ-বন্ধন হারাম, তাঁরাই মাহরাম, যেমন, নিজ পিতা, শ্বশুর, ভাই, মামা, চাচা, ভাতিজা, ভাগিনা ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ২৩ নং আয়াতে মাহরাম ব্যক্তিদের তালিকা দেয়া হয়েছে।

মীকাত - ৮

মীকাতের অর্থ সীমানা বা নির্দিষ্ট স্থান। মীকাতের সাথে সময়ও নির্ধারিত। হজ্ব বা উমরাহ্ করার জন্য যেসব নির্ধারিত স্থান থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়, সে স্থানকে মীকাত বলে। আল্লহতাআ’লা জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে মীকাতের নির্ধারিত স্থানগুলো হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-কে দেখিয়ে দিয়েছেন। কা’বা শরীফের বিভিন্ন দিকে প্রধান ৫টি মীকাত নির্ধারণ করা আছে, যেমনঃ- ইয়া লাম্ লাম, যুল্হুলায়ফা, আল-যুহফাহ, যাতুলইরাক, কারনুল মানাযিল। ইহরাম ধারণ করা ছাড়া মীকাত অতিক্রম করলে জরিমানা হিসেবে একটি দম অর্থাৎ একটি ছাগল বা একটি দুম্বা কুরবানি দিতে হয়। (মীকাতের সীমানার নক্সা দেখুন)

আমের ও মামুর - ৯

বদলী হজ্ব করার জন্য যে ব্যক্তি কাউকে প্রেরণ করেন, তাঁকে অর্থাৎ প্রেরণকারীকে ‘আমের’ আর প্রেরিত ব্যক্তিকে (অর্থাৎ আদিষ্ট ব্যক্তি) মামুর বলে।

হাতীম - ১০

হাতীমের শাব্দিক অর্থ ‘টুকরা’। যেহেতু এটি কা’বা ঘরেরই একটি টুকরা তাই এর নাম হাতীম। কা’বা ঘরের উত্তর পার্শ্বে ৪ ফুট ৫ ইঞ্চি উঁচু (ধনুকের মতো বাঁকানো) দেয়ালে ঘেরা ছাদ বিহীন খালি জায়গা,,যা কা’বা ঘরের মূল অংশ। খলীলুল্লাহর নির্মিত কা’বায় ছুটে যাওয়া অংশও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কা’বা সংস্কারের সময় কুরাইশদের অর্থ সংকট হয়েছিল। তখন সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ইব্রাহীম (আঃ) এর নির্মিত অংশের কিছু অংশ বাদ দেওয়া হোক। 

বর্তমান হাতীমের অংশটি বাদ দিয়ে তখন কা’বার দেয়াল নির্মিত হয়। হাতীম বাইতুল্লার অংশ বিধায় তওয়াফ হাতীমের বাইরে দিয়ে করতে হয়। এর ভেতর দিয়ে তওয়াফ করা নিষেধ। হাতীমের ভেতর নামাজ পড়লে কা’বা শরীফের ভেতরে নামাজ পড়ার সমতুল্য হবে। 

কেননা এ অংশটি আদি কা’বা শরীফের অন্তর্ভুক্ত। মক্কা বিজয়ের দিন মা আয়েশা (রাঃ) সর্বপ্রথম হাতীমের মধ্যে দু’রাকাআ’ত নামাজ আদায় করেছিলেন বলে জানা যায়। হাতীমকে হিজরও বলে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর স্ত্রী বিবি হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈলকে এ স্থানেই রেখে গিয়েছিলেন। তাঁদের কবরও এখানেই আছে বলে কথিত।

মাতাফ - ১১

বাইতুল্লাহ শরীফের চারদিকে তওয়াফের জন্য সাদা রং এর মার্বেল পাথর দ্বারা আবৃত ছাদ বিহীন খোলা জায়গা/চত্বরকে মাতাফ বলে। বাইতুল্লাহ শরীফকে তওয়াফ করার এটাই মূল স্থান। যদিও প্রয়োজনে মাসজিদুল হারামের দোতলা দিয়ে এবং ছাদের উপর দিয়েও তওয়াফ করা যায়।

মুলতাযাম - ১২

হাজরে আস্ওয়াদ ও বাইতুল্লাহর দরজার মধ্যবর্তী স্থান/দেয়াল, যাতে বুক লাগিয়ে দুআ’ করা সুন্নাত এবং দুআ’ কবুলের এটি একটি বিশেষ স্থান। হাজরে আসওয়াদের কোণা থেকে দরজার চৌকাঠ পর্যন্ত মাত্র ৪ ফুট স্থানকে মুলতাযাম বলে। এখানে সর্বদা চরম ভিড় থাকে।

মাকামে ইব্রাহীম - ১৩

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কা’বা শরীফ নির্মাণ করেছিলেন, সেটাকেই মাকামে ইব্রাহীম বলে। প্রকৃতপক্ষে ‘মাকাম’ অর্থ ঠিকানা, গন্তব্য, আবাসস্থল, চিহ্ন ইত্যাদি। মাকামে ইব্রাহীম শুধুমাত্র পায়ের ছাপ সম্বলিত পাথরের টুকরাটি-ই নয় বরং এ স্থানটি হলো আল্লহর প্রিয় নবী ইব্রাহীম (আঃ) এর আবাসস্থল। আল্লাহতাআ’লা ইব্রাহীম (আঃ)-এর পায়ের চিহ্ন ঐ পাথরের উপর খোদাই করে রাখেন, যাতে তাঁর বংশধর এবং কিয়ামাত পর্যন্ত আগত মানুষের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। 

মাকামে ইব্রাহীমের ঐ পাথরকে আল্লহ নিজ কুদরতে ও রহমতে নরম করে দিয়েছিলেন। ইব্রাহীম (আঃ)-এর পদচিহ্নসহ পাথরটি কা’বার অনতিদূরে কাঁচের ও গ্রীলের ভেতর সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। আল্লহতাআ’লা সূরা বাকারার ১২৫ নং আয়াত (ওয়াত্তাখিযু মিম্ঁ মাক্বামি ইব্রাহীমা মুসল্লা) নাযিল করে এ স্থানটিকে নামাজের স্থান বানাতে বলেছেন। 

আয়াতের অর্থঃ ‘এবং আমি লোকদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলাম যে ইব্রাহীম যেখানে ইবাদাতের জন্য দাঁড়ায়, সেস্থানকে স্থায়ীভাবে নামাজের জায়গারূপে গ্রহণ করো’। অথবা ‘তোমরা মাকামে ইব্রাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ করো’। অথবা ‘(বরকত লাভের জন্য) তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাজের জায়গা বানাও’। মাকামে ইব্রাহীম বলতে শুধু ঐ পাথরটিকে বুঝানো হয়নি, বরং সে স্থানটিকে বুঝানো হয়েছে। পদচিহ্ন খচিত পাথরটি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে মাত্র এক ফুট। হাদীস শরীফ অনুযায়ী মাকামে ইব্রাহীম ও হাজরে আস্ওয়াদ জান্নাত থেকে প্রেরিত ইয়াকুত পাথর (তিরমিযী, ১ঃ১৭৭)।

মীজাবে রহমত - ১৪

কা’বা শরীফের ছাদের পানি নিস্কাশনের জন্য স্বর্ণ দিয়ে তৈরি নালাকে মীজাবে রহমতো বলে। এটি কা’বার উত্তর দেয়ালের উপর ছাদের সাথে স্থাপিত আছে। এ নালা দিয়ে ছাদের পানি হাতীমের ভেতর পড়ে। এ নালার নিচে দাঁড়িয়ে দুআ’ করলে দুআ’ কবুল হয়। এখানে এ দুআ’টি করা যেতে পারে, ‘হে আল্লহ্! আমি তোমার কাছে এমন ঈমান চাই, যা কখনো বিলীন হয় না। এমন বিশ্বাস চাই যা শেষ হয় না এবং তোমার নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর সঙ্গ চাই। হে আল্লহ্! যে দিন তোমার আরশের ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া থাকবে না, সে দিন তোমার আরশের নিচে আমাকে স্থান দিও এবং মুহাম্মদ (সঃ) এর হাউজে কাওছারের পানি পান করাইও, যার পর আর পিপাসা না লাগে।’

হাজরে আস্ওয়াদ - ১৫ 

কা’বা শরীফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে প্রায় সাড়ে তিন ফুট উঁচুতে স্থাপিত বেহেশতী কালো পাথর। হযরত আদম (আঃ) এর মনোবাসনা পূরণ করার উদ্দেশ্যে আল্লহ্তাআ’লা ফেরেশতা দ্বারা এ বেহেশতী পাথরটি কা’বা শরীফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্থাপন করে দেন। হাজরে আস্ওয়াদ প্রথমে ধবধবে সাদা ছিল। অতঃপর চুম্বনকারী/ইস্তেলামকারীদের গুনাহ্সমূহের প্রভাবে তা কালো হয়ে যায়। 

হাদীস শরীফে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, রসূল (সঃ) ইরশাদ করেছেন, হাজরে আস্ওয়াদ জান্নাত থেকে এসেছে। এটি দুধের চেয়েও অধিক শুভ্র ছিল। অতঃপর আদম সন্তানের গুনাহসমূহ এটিকে কালো করে দিয়েছে। (তিরমিযী হাঃ নং ৮৭৭, সহীহ ইবনে খুযাইমা হাঃ নং ২৩৩)।

কা’বা ঘরের এ কোণা থেকেই তওয়াফ শুরু হয় এবং এখানে এসেই তওয়াফ শেষ হয়। এ পাথর স্পর্শ বা ইছতিলাম (চুম্বন) দ্বারা হাজীদের সগীরাহ (ছোট) গুনাহসমূহ ঝরে যায় (তিরমিযী ঃ ১/১৯০)। 

রসূল (সঃ) তওয়াফের শুরুতে এ পাথরকে ইছতিলাম (চুম্বন) করেছেন। কখনো হাত বা লাঠি দ্বারা ইশারা করেও ইছতিলাম করেছেন। সুতরাং মুসলমানদের জন্য হাজরে আস্ওয়াদকে চুম্বন করা একটি সুন্নাত আ’মল। বর্তমান সময়ে হজ্বের মৌসুমে এ আ’মলটি করা এক কঠিন ব্যাপার। তাই সম্ভব হলে চুম্বন করবেন, নতুবা দূর থেকে হাতে ইশারা করে ইছতিলাম করবেন। কিন্তু এ কাজটি করতে গিয়ে পুরুষে-পুরুষে বা মহিলা-পুরুষে ঠেলা-ঠেলি ও ধাক্কাধাক্কি করে অন্যকে কষ্ট দেয়া হারাম।

শাওত - ১৬

কা’বা ঘরের চতুর্দিকে একবার প্রদক্ষিণ করাকে শাওত বলে।

তওয়াফ - ১৭

তওয়াফ শব্দের অর্থ প্রদক্ষিণ করা। ইসলামের পরিভাষায় শরীয়তের বিধান অনুসারে কা’বার চারদিকে ৭ বার প্রদক্ষিণ করাকে তওয়াফ বলে। একমাত্র কা’বা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো বস্তু বা স্থানে তওয়াফ করার কোনো সুযোগ নেই। কা’বা ঘরের ৪টি কোণা/রুকন। হাজরে আস্ওয়াদের কোণা থেকে তওয়াফ শুরু হয় এবং এখানে এসেই তওয়াফ শেষ হয়। উমরাহ্ ও হজ্বের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ফরজ আ’মল হলো তওয়াফ করা। 

মক্কায় অবস্থানকালে অন্যান্য নফল ইবাদাতের মধ্যে নফল তওয়াফ করা সর্বশ্রেষ্ঠ নফল আ’মল। নামাজের মাধ্যমে বান্দা যেমন আল্লহ্কে খুশি করার জন্য ধ্যানে মগ্ন হয়, ঠিক তওয়াফের মাধ্যমেও আল্লহর সন্তুষ্টির জন্য, আল্লহ্কে পাওয়ার জন্য বান্দা-বান্দী নিজেকে বিলীন করে দেয়। তাই তওয়াফকে চলন্ত নামাজও বলা হয়।

তওয়াফে কুদুম - ১৮ 

মীকাতের বাহির থেকে আগত ইফরাদ হজ্ব পালনকারীর জন্য মক্কায় এসেই কা’বার সম্মানে একটি তওয়াফ করা সুন্নাত, একে তওয়াফে কুদুম বলে। এ তওয়াফের পর সায়ী নেই।

তওয়াফে উমরাহ্ - ১৯ 

এটি উমরাহর ফরয আরকান/শর্ত/হুকুম। উমরাহর নিয়তে ইহরাম পরিধান করে মক্কায় পৌঁছে প্রথমেই যে তওয়াফ করতে হয়, তাকে তওয়াফে উমরাহ্ বলে। এ তওয়াফে রমল ও ইজতিবা করতে হয়। এ তওয়াফের পর সায়ী করতে হয়।

তওয়াফে যিয়ারাহ/যিয়ারত - ২০

এটি হজ্বের ফরজ তওয়াফ, যা উকূফে আরাফার পর করা হয়। এ তওয়াফ হজ্বের তৃতীয় ফরজ আ’মল। একে তওয়াফে ইযাফা, তওয়াফে রুকন এবং তওয়াফে মাফ্রুযও বলে। এ তওয়াফ ১০/১১/১২ যিল্হজ্ব তারিখের মধ্যে আদায় করতে হয়।

তওয়াফে বিদা/তওয়াফে সাদর - ২১

মীকাতের বাহির থেকে আগত হাজীদের জন্য হজ্বের পর মক্কা মুকাররামা থেকে বিদায়ের পূর্বে একটি তওয়াফ করা ওয়াজিব। একে তওয়াফে বিদা বা তওয়াফে সাদর বলে। এ তওয়াফের পর সায়ী নেই।

রুকনে হাজরে আস্ওয়াদ -২২ 

কা’বা শরীফের এটি হাজরে আস্ওয়াদের কোণা। এখান থেকে তওয়াফ শুরু ও শেষ হয়।

রুকনে ইরাকী - ২৩ 

কা’বা শরীফের উত্তর-পূর্ব কোণাকে রুকনে ইরাকী বলে। এটি ইরাকের দিকে- তাই এমন নাম করা হয়েছে ।

রুকনে শামী - ২৪ 

কা’বা শরীফের উত্তর-পশ্চিম কোণাকে রুকনে শামী বলে। এটি শাম/সিরিয়ার দিকে- তাই এমন নামকরণ করা হয়েছে।

রুকনে ইয়ামানী - ২৫ 

কা’বা শরীফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণাকে রুকনে ইয়ামানী বলে। যেহেতু এটি ইয়ামান দেশের দিকে, তাই এমন নামকরণ করা হয়েছে।

সাফা ও মারওয়া - ২৬ 

সাফা ও মারওয়া কা’বা শরীফের নিকটস্থ দুটি পাহাড়। সাফা কা’বা শরীফের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ৭০-৮০ মিটার দূরে অবস্থিত। আর মারওয়া উত্তর-পূর্ব দিকে প্রায় ৩০০ মিটার দূরে অবস্থিত। আল্লহর হুকুমে বিবি হাজেরা এবং শিশু পুত্র ইসমাঈল (আঃ) জনমানবহীন মরু প্রান্তরে নির্বাসিত হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে খাদ্য ও পানির অভাবে ইসমাঈলের মৃতপ্রায় অবস্থা এবং তজ্জনিত মাতা হাজেরার নিদারুণ মর্মপীড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এ দুপাহাড়ের স্মৃতিকথা। 

পানির সন্ধানে মা হাজেরা এ দুপাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। এসময় আল্লহর অনুগ্রহে নিশ্চিহ্ন কা’বার সন্নিকটে এক অলৌকিক প্রস্রবণ (যমযম) প্রবাহিত হয়েছিল। 

কাজেই এ পাহাড় দুটি আল্লহ্র নিদর্শনাদির অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত। সাফা মারওয়ার বর্তমান অবস্থা দেখে পৃথিবীর কোনো মুসলমান মা হাজেরা ও শিশু ইসমাঈলের যুগের সাফা-মারওয়ার অবস্থা কল্পনাও করতে পারবে না। সুতরাং ইতিহাস পড়ূন এবং তখনকার অবস্থা জানুন। তাহলে মা হাজেরার কষ্টের কথা কিছুটা অনুভব করতে পারবেন।

মাইলাইনে আখ্দারাইন - ২৭

সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী সবুজ বাতি চিহ্নিত স্থান, যেখানে পুরুষ হাজীদের দৌড়াতে হয়। বিবি হাজেরার দৌড়াদৌড়ি করার স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য হজ্বের কার্যক্রমে এ আমলটিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এটি সুন্নাত আ’মল।

ইছতিলাম - ২৮ 

হাজরে আস্ওয়াদ কালো বেহেশতী পাথরকে চুম্বন করা বা স্পর্শ করাকে ইছতিলাম বলে। মুখ/ঠোঁট দ্বারা চুম্বন করতে না পারলে হাত বা লাঠি দ্বারা ইশারা করলেও চুম্বন করার সুন্নাত আ’মল আদায় হয়ে যায়।

ইজতিবা - ২৯ 

ইহরামের কাপড়কে অর্থাৎ গায়ের চাদরকে ডান কাঁধের নিচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধে রাখা। অর্থাৎ ডান কাঁধ খোলা রাখা। এটি পুরুষ হাজীদের জন্য সুন্নাত আ’মল। শুধু ফরজ তওয়াফের সময় ৭ চক্করেই ইজতিবা করতে হয়। তওয়াফ শেষ হলেই ইজতিবা শেষ হবে।

রমল -৩০ 

তওয়াফের প্রথম ৩ চক্করে দু’কাঁধ হেলিয়ে দুলিয়ে বীরের/বাহাদুরের মতো চলাকে রমল বলে। এটি সুন্নাত আ’মল। ৭ম হিজরীতে উমরাহ্ করার সময় মদীনা থেকে আগত সাহাবাগণ যখন তওয়াফ করছিলেন, তখন কফির-মুশরিকরা কা’বার চত্বরে বসে তাদের তওয়াফ দেখছিল এবং মন্তব্য করছিল যে, মদীনা গিয়ে মুসলমানরা দুর্বল হয়ে পড়েছে, যে জন্য তারা ভালোভাবে হাঁটতেও পারছেন না। 

রসূল (সঃ) মুশরিকদের এ মন্তব্য শুনে সাহাবাদেরকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা ইহরামের চাদরকে ডান হাতের বগলের নিচ দিয়ে নিয়ে চাদরের দু’কিনারা বাম কাঁধের উপর রেখে ডান কাঁধকে উন্মুক্ত রাখো এবং বীরের ন্যায় দ্রুত পদক্ষেপে দু’কাঁধ হেলিয়ে দুলিয়ে প্রথম তিন চক্কর তওয়াফ করো, যাতে কাফেররা তোমাদের তেজস্বিতা দেখতে পায়। এ ঘটনা থেকেই রমল ও ইজতিবার প্রচলন শুরু হয় এবং সুন্নাত আ’মল হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।

হারাম/হেরেম - ৩১ 

কা’বা শরীফের চতুর্দিকে নির্দিষ্ট সীমানায় সংরক্ষিত এলাকা। এ এলাকা বিশেষ সম্মান ও মান মর্যাদার স্থান। এ সীমানার মধ্যে সকলেই, এমনকি জীব-জন্তুও নিরাপদ। এ সীমানাকে হুদুদে হারামও বলে।

হেরেমী - ৩২হা

হারামের সীমানার মধ্যে বসবাসকারী বাসিন্দা।

আফাকী - ৩৩

মীকাতের বাইরে বসবাসকারী লোক।

হিল্ল - ৩৪

হারামের সীমানার বাইরে, কিন্তু মীকাতের সীমানার ভেতরের এলাকা। মক্কার অধিবাসীদের উমরাহ্ করার জন্য হিল্ল এলাকা থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়ে। কিন্তু হজ্বের ইহরাম নিজ নিজ বাড়ি থেকেই বাঁধা জায়েয।

তাক্বীর - ৩৫ 

‘আল্লহু আকবার’ বলা।

তাসবীহ্ - ৩৬ 

‘সুব্হানাল্লহ’ বলা।

তাহলীল - ৩৭ 

‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা।

তামাত্তু - ৩৮ 

৩ প্রকার হজ্বের মধ্যে তামাত্তু এক প্রকার হজ্ব। এ হজ্বে প্রথমে উমরাহর নিয়তে ইহরাম বেঁধে উমরাহ্ সম্পন্ন করে ইহরাম মুক্ত হতে হয়। অতঃপর হজ্বের ইহরাম বেঁধে হজ্ব আদায় করতে হয়।তামাত্তু হজ্বে হাদী (পশু) জবাই করা ওয়াজিব।

ক্বিরান - ৩৯ 

একই ইহরামে উমরাহ্ ও হজ্ব উভয়টি আদায় করা। এ হজ্বে পশু জবাই করা ওয়াজিব।

ইফরাদ - ৪০ 

শুধুমাত্র হজ্বের নিয়তে ইহরাম বেঁধে হজ্ব সম্পাদন করা। এ হজ্বে পশু জবাই নেই। পশু জবাই করা ঐচ্ছিক (নফল)।

হালক - ৪১

মাথার চুল মুন্ডানো অর্থাৎ রেজর/ব্লেড দ্বারা চুল চেঁছে ফেলা। এটি ওয়াজিব।

কসর - ৪২

মেশিন দ্বারা মাথার সম্পূর্ণ চুল ছোট করা। এটি ওয়াজিব।

ওযর - ৪৩ 

এর অর্থ হলো শরীয়তে গ্রহণযোগ্য কারণ বা অবস্থা, যেমন শারীরিক গুরুতর অসুস্থতা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, জীব জানোয়ারের বা শত্রুর আক্রমণের ভয় ইত্যাদি, যে সব কারণে কোনো ফরজ/ওয়াজিব আ’মল করা সম্ভব হয় না। যেমনঃ অসুস্থতার কারণে পাথর মারা বা মুযদালিফায় রাত্রি যাপন সম্ভব হয় না, জামাআ’তে নামাজ পড়া সম্ভব হয় না ইত্যাদি। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। অসত্য অজুহাত দেখিয়ে ওযরের ফায়দা নেয়া যাবে না।

দম - ৪৪

হজ্বের সফরে মক্কায় অবস্থানকালে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করার জন্য বা হজ্ব/উমরাহর কোনো ওয়াজিব আমল সম্পাদন না করার বা ভুল করার জন্য ক্ষতিপূরণ স্বরূপ মক্কায় অবস্থানকালেই ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু বা উট জবাই করতে হয়, একে দম বলে। দম আদায় করা ওয়াজিব।

হাদী - ৪৫ 

হারামের সীমার ভিতরে কুরবানি করার জন্য আনীত পশুকে হাদী বলে।

জামারাহ্ - ৪৬

জামরাহ অর্থ মীনায় কংকর (ছোট পাথর) নিক্ষেপ করার স্থান। এ শব্দের বহুবচন হলো জামারাহ্। মীনার দিক থেকে প্রথম জামরাহ্কে ছোট, মধ্যেরটিকে মেজো ও শেষেরটিকে (যেটি মক্কার দিকে) বড় জামারাহ্ বলে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যখন তাঁর সন্তান ইসমাঈলকে কোরবানী করার জন্য মীনার ময়দানের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন শয়তান এই তিনটি স্থানে ইসমাঈলকে ধোঁকা দিয়েছিল। তাই শয়তানকে পাথর মারা একটি প্রতীকী আ’মল।

রমী - ৪৭

মীনার জামারাহ্তে (শয়তানের প্রতি) কংকর/পাথর নিক্ষেপ করাকে রমী বলে। এটি হজ্বের একটি ওয়াজিব আ’মল।

ইয়াওমে তারবীয়াহ্  - ৪৮

হজ্বের প্রস্তুতির দিন অর্থাৎ যিলহজ্বের ৮ তারিখকে ‘ইয়াওমে তারবীয়াহ’ বলে।

ইয়াওমু আরাফাহ্হ - ৪৯

হজ্বের প্রধান দিন। যিলহজ্বের ৯ তারিখ কে ‘ইয়াওমু আরাফাহ্’ বলে। যাঁরা হজ্ব করেন, তাঁরা ব্যতীত অন্যান্য মুসলমানদের জন্য এ দিন রোযা রাখা সুন্নাত।

আইয়্যামুত তাশ্রীক/তাকবীরে তাশ্রীক - ৫০ 

৯ যিল্হজ্ব ফজর থেকে ১৩ যিলহজ্বের আছর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্তে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ‘আল্লহু আকবার, আল্লহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্ল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লহু আকবার অলিল্লাহিল হামদ্’ তাকবীর পাঠ করতে হয়। এ তাকবীর একবার পড়া ওয়াজিব আর ৩ বার পড়া সুন্নাত। আল্লহ্ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেন ‘ওয়াজ কুরুল্লাহা ফী আইয়্যা মিম্ঁ মা‘আদূদাত’ অর্থঃ আর তোমরা আল্লহ্কে স্মরণ করো (আইয়্যামে তাশরীকের) নির্দিষ্ট দিনগুলোতে। (সূরা বাকারা-২০৩নং আয়াত)।

একাধিক সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে প্রমাণিত আছে যে, তাঁরা ৯ তারিখ (আরাফার দিন) ফজর থেকে ১৩ তারিখ আছর পর্যন্ত তাকবীর পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা- হাদীস নং ৫৬৯৬-৯৯)। 

হযরত আলী(রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি যিলহজ্বের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তাকবীরে তাশরীক পাঠ করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং ৫৬৭৮)

ইয়াওমুন নাহর - ৫১ 

যিল্হজ্ব মাসের ১০ তারিখ কে ইয়াওমুন নাহর বলে। ১০, ১১ ও ১২ তারিখ পর্যন্ত কুরবানি করা যায়। নহর অর্থ প্রবাহ, যেমন কুরবানির রক্তের নহর বয়ে যাওয়া।

মীনা - ৫২

মীনা অর্থ- প্রবাহিত। এখানে কুরবানির রক্ত প্রবাহিত হয় বলে এ স্থানের নাম মীনা রাখা হয়েছে। মক্কা শরীফ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অনুমান ৬/৭ কিঃমিঃ দূরে একটি উপত্যকা। এখানকার হাজার হাজার তাঁবুতে হাজীদেরকে ৮ থেকে ১২/১৩ যিল্হজ্ব তারিখ ( ৯ যিল্হজ্ব ব্যতীত) পর্যন্ত অবস্থান করে হজ্বের বেশিরভাগ কার্যক্রম পালন করতে হয়। অতএব, মীনাকে হজ্বের ‘বেইজ ক্যাম্প’ হিসেবে গণ্য করা হয়। 

মীনার তাঁবুতে অবস্থান করা জরুরী সুন্নাত। রসূল (সঃ) সাহাবীদেরকে নিয়ে ৮ থেকে ১৩ যিল্হ্জ্ব পর্যন্ত এখানে অবস্থান করে হজ্বের সকল কার্যক্রম পালন করেছেন। শরীয়ত সম্মত ওযর ব্যতীত এ সুন্নাত আ’মলটি পালন না করা- খেলাফে সুন্নাত।

আরাফাহ্ - ৫৩ 

কা’বা শরীফ থেকে প্রায় ১৫/১৬ কিঃমিঃ পূর্বে হারামের সীমানার বাইরে একটি বিশাল ময়দান। এটি একটি বড় উপত্যকা। বাবা আদম এবং মা হাওয়া সুদীর্ঘকাল আলাদা থাকার পর এ স্থানেই মিলিত হয়েছিলেন এবং আল্লহর নিকট ক্ষমা-ভিক্ষা চেয়ে ক্ষমা পেয়েছিলেন। সূরা:আ’রাফ ২৩ নং আয়াত দেখুন। 

৯ যিল্হজ্ব তারিখে এ ময়দানে উকূফ বা অবস্থান করা হজ্বের প্রধান ফরজ/রুকন। এ স্থানেই আল্লহ সবচেয়ে বেশী বান্দা-বান্দীদেরকে ক্ষমা করেন। তাই আরাফাকে ক্ষমা ও মুক্তির ময়দান বলা হয়। আরাফায় অবস্থানকালে আ’মলের বিস্তারিত বিবরণ হজ্বের অধ্যায়ে পাবেন।

মুয্দালিফা - ৫৪

মীনা থেকে ৬/৭ কিঃ মিঃ পূর্বে মীনা ও আরাফার মধ্যবর্তী একটি ময়দান। হাজীগণ আরাফায় অবস্থান শেষে এখানে এসে (৯ ও ১০ যিলহজ্ব তারিখের মধ্যবর্তী রাত) খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করেন এবং সুব্হে সাদিক থেকে সূর্য উদয় পর্যন্ত এখানে অবস্থান করা হজ্বের প্রথম ওয়াজিব আ’মল। বাবা আদম এবং মা হাওয়া আরাফাতে মিলিত হয়ে এখানে এসে রাত্রি যাপন করেছিলেন। এটি হজ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকন।

জান্নাতুল মাআ’লা - ৫৫

মক্কা মুকাররামার ঐতিহাসিক কবরস্থান। রসূল (সঃ) এর বংশধররা, বিবি খাদীজাসহ অগণিত সাহাবাগণ এখানে সমাহিত আছেন। এটি মক্কার সবচেয়ে বড় কবরস্থান।

জান্নাতুল বাকী - ৫৬

মদীনা শরীফের ঐতিহাসিক কবরস্থান, যা মাসজিদুন নববী সংলগ্ন দক্ষিণ পূর্বদিকে অবস্থিত। এখানে হযরত উসমান (রাঃ) সহ অগণিত সাহাবী, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন ও আল্লহর অলীগণ কবরস্থ আছেন। শুধু মা খাদীজা ও বিবি মায়মুনা ব্যতীত হুজুর (সঃ) এর সকল স্ত্রী ও সন্তানগণ এখানে সমাহিত আছেন। এ কবরস্থান যিয়ারত করা অসীম সাওয়াবের কাজ।

মাশ্আ’রিল হারাম - ৫৭

মীনার দিকে মুযদালিফার শেষ প্রান্তে ‘কুযাহ’ নামে একটি পাহাড় আছে, একে ‘মাশ্আ’রুল হারাম’ বলে। এখানে একটি মাসজিদ রয়েছে, যার নাম মাসজিদু মাশ্আ’রিল হারাম। কারো কারো মতে

সম্পূর্ণ মুযদালিফাকেই মাশ্আরুল হারাম বলে (দুররে মুখতার ও শামী, ২ঃ৫০৮, তাফসীরে রূহুল মা’আনী, ১ঃ৪৮৪)।

জাবালে নূর বা হেরা গুহা- ৫৮

ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৫০০ ফুট উঁচু মক্কার একটি প্রসিদ্ধ পাহাড়। এ পাহাড়ের চ‚ড়া থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় ৩০ ফুট নিচে অন্য একটি চ‚ড়ায় রয়েছে গারে হেরা বা হেরা গুহা। এখানেই হুজুর (সঃ)-এর উপর সর্বপ্রথম অহী অর্থাৎ সূরা আ’লাক এর প্রথম ৫টি আয়াত নাযিল হয় এবং তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন। নবুয়ত প্রাপ্তির ৬ মাস পূর্ব থেকেই কয়েকদিন অন্তর অন্তর এ গুহাতেই হুজুর (সঃ) ৬ মাস পর্যন্ত নির্জনে একাকী আল্লহর যিকির ও মুরাকাবা করেছেন। 

এ নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় বিবি খাদিজা (রাঃ) হুজুর (সঃ)-কে খাবার দিয়ে যেতেন। এ গুহার ভেতর থেকে পাথরের ফাঁক দিয়ে কা’বা শরীফ দেখা যায়। বর্তমানে সুউচ্চ বিল্ডিং এর জন্য উক্ত গুহা থেকে কা’বা শরীফ দেখা যায় না। যাদের পক্ষে সম্ভব হেরা গুহায় উঠে পরিদর্শন করবেন। তাহলে এ গুহার অলৌকিকত্ব ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন এবং হুজুর (সঃ) এবং মা খাদিজা (রাঃ) কত কষ্ট করেছেন তা অনুভব করতে পারবেন।

জাবালে রহমত - ৫৯

আরাফার ময়দানে একটি প্রসিদ্ধ পাহাড়। এ পাহাড়ের ২০০ ফুট উঁচু চূড়ার মাঝে মানুষের তৈরি একটি সাদা পিলার রয়েছে। রসূল (সঃ) এ পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে লক্ষাধিক সাহাবার উপস্থিতিতে বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক খুতবা (ভাষণ) দিয়েছিলেন। এ পাহাড়ে উঠা এবং এখানে নামাজ পড়ার মধ্যে কোনো বৈশিষ্ট্য/সাওয়াব নেই।

জাবালে সাওর - ৬০

ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০০ ফুট উঁচু মক্কার একটি প্রসিদ্ধ পাহাড়। হারাম শরীফ থেকে প্রায় ৫ কিঃমিঃ দক্ষিণে এর অবস্থান। রসূল (সঃ) হিজরতের সময় কাফেরদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য হযরত আবু বকর (রাঃ) কে নিয়ে এ পাহাড়ের এক গুহায় আশ্রয় নিয়ে ৩ দিন আত্মগোপন করেছিলেন। এ গুহাকে গারে সওর বলে। এটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন।

জাবালে আবু কোবায়েস - ৬১ 

এ পাহাড়ের চূড়ায় মসজিদে বিলাল ছিল। কা’বা ঘরের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে, আল্লহ পাকের নির্দেশে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এ পাহাড়ে উঠে সারা পৃথিবীর লোকদেরকে হজ্বের ডাক দিয়েছিলেন। নূহ (আঃ) এর মহাপ্লাবনের সময় হাজরে আস্ওয়াদ পাথরটিকে এ পাহাড়েই আমানত রাখা হয়েছিল। এ পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়েই রসূল (সঃ) মুশরিকদের দাবীতে, তাদের বিশ্বাস অর্জনে এবং আল্লহর আদেশে আঙ্গুলের ইশারায় চন্দ্রকে দ্বিখন্ডিত করেছিলেন, যাকে ‘শাক্কল কমার’ বলা হয়। বর্তমানে এ পাহাড়ে রাজ প্রাসাদ তৈরি হয়েছে। তাই এখন আর মসজিদে বেলাল ও শাক্কল কমার যিয়ারত করা যায় না। বর্তমানে এগুলোর আর অস্তিত্ব নেই।

মাসজিদে খাইফ - ৬২

মীনার ময়দানে একটি মাসজিদ। ৭০ জন নবী এখানে নামাজ আদায় করেছেন বলে জানা যায়। এখানে অনেক নবী পয়গাম্বরগনের কবর আছে বলে কথিত আছে।

মাসজিদে নামিরাহ - ৬৩

আরাফার এক প্রান্তে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মাসজিদ। এ মাসজিদ থেকে হজ্বের খুতবা দেয়া হয়। হজ্বের ইমাম এ মাসজিদ এবং সংলগ্ন এলাকার হাজীদেরকে নিয়ে জামাআ’ত করে যোহর ও আছরের নামাজ একত্রে আদায় করেন। এ মসজিদের কিছু অংশ আরাফাহর সীমানার বাইরে পড়েছে। সুতরাং সাবধান! সে অংশে উকূফ করবেন না।

মাসজিদে জ্বীন - ৬৪

মীনায় যাবার রাস্তার পাশে জান্নাতুল মুয়াল্লাহর (মক্কার কবরস্থান) দিকে অবস্থিত। এখানে জ্বীন সম্প্রদায় হযরত নবী কারীম (সঃ)- এর নিকট থেকে কোরআন তেলওয়াত শুনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাই এই মাসজিদ ‘মাসজিদে জ্বীন’ নামে প্রসিদ্ধ।

মুহাস্সির - ৬৫ 

৫৪৫ হাত দীর্ঘ একটি নিচু স্থান। এটি আরাফাহ হতে মীনায় প্রত্যাবর্তনের পথে পড়ে। কা’বা ঘর ধ্বংস করার মানসে আগত দাম্ভিক আবরাহা বাদশাহ্ ও তার হস্তী বাহিনী এখানেই আল্লহর গযবে নিপতিত হয়েছিল। ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট ছোট পাখীর কংকর নিক্ষেপে সে বিশাল বাহিনী (হস্তীসহ) ধ্বংস হয়েছিল। গযবের স্থান বিধায় এ স্থানটুকু দ্রুতগতিতে অতিক্রম করতে হয় (সূরাঃ ফীল)। এ স্থানটি সাইনবোর্ড দিয়ে চিহ্নিত করা নেই, বিধায় স্থানটির অবস্থান নির্ণয় করা কঠিন।

মাওলিদুননাবী - ৬৬

এটি আব্দুল মোত্তালিবের বাড়ী। এ বাড়ীতেই নবী কারীম (সঃ) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এটি মারওয়া পাহাড় থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কয়েকশত গজ দূরে। বর্তমানে এটি একটি লাইব্রেরী।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url