হজ্ব সফরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং হজ্বে যাওয়ার পূর্বে বহুমুখী প্রস্তুতি গ্রহণ

হজ্ব সফরের গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ

ক) এ সফর অতি গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতময় সফর।

খ) এ সফর আল্লহর মেহমান হয়ে কালো গিলাফে ঢাকা বাইতুল্লাহর যিয়ারত করার এবং চিরসবুজ গম্বুজের নিচে চিরনিদ্রায় শায়িত নবী কারীম (সঃ) এর মাসজিদুন নববী ও রওজাপাক যিয়ারত করার সফর।

গ) এ সফর দুনিয়াবী ব্যবসা-বাণিজ্য, দেশভ্রমণ বা পিকনিকের সফর নয়। এ সফর আল্লহর সাথে লেনদেনের সফর।

ঘ) এ সফর অন্তরের নম্রতা, দাসত্ব ও আল্লাহমুখিতার এক অনন্য শিক্ষাঙ্গন।

ঙ) এ সফর চরম ধৈর্য পরীক্ষার, ক্ষমা-ত্যাগ ও কষ্টের সফর।

চ) এ সফর সারাজীবনের পুঞ্জীভুত পাপ-পংকিলতা ধুয়ে মুছে নিঃস্পাপ হওয়ার সফর।

ছ) এ সফর জান্নাত অর্জনের, তাই অনেক কষ্ট সত্তেও মহা আনন্দের সফর।

জ) এ সফর কা’বা শরীফের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে আল্লহর দীদার লাভের সফর।

ঝ) এ সফর সোনার মদীনা তথা নবী কারীম (সঃ) এর সান্নিধ্য এবং তাঁর শাফাআ’ত লাভের সফর।

ঞ) এ সফর দুআ’ কবুলের সফর।

ট) এ সফর নিজেকে পরিবর্তন করার/বদলানোর সফর।

ঠ) এ সফর জীবনের নতুন অধ্যায় সূচনা করার সফর।

ড) সর্বোপরি এ সফর দুনিয়া-আখিরাতের মহা সাফল্য অর্জনের সফর। সুতরাং এ মহা বরকতময় সফরে কৃতকার্য হওয়ার জন্য কঠোর সাধনা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে হজ্বের জন্য প্রস্তুত হউন।

হজ্বে যাওয়ার পূর্বে বহুমুখী প্রস্তুতি গ্রহণ

ক। পড়াশুনা ও তালীম গ্রহণের প্রস্তুতিঃ

(১) যেহেতু হজ্ব একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বড় মাপের ইবাদাত, তাই আল্লহ তাআ’লা এ ইবাদাতের পুরস্কারও রেখেছেন অনেক বড় অর্থাৎ ‘শিশুর মতো নিষ্পাপ হওয়া ও জান্নাত পাওয়া’। এতো বড় পুরস্কার পাওয়ার জন্য তো ব্যাপকভাবে পড়াশুনা করে ও প্রশিক্ষণ নিয়ে হজ্ব করতে যেতে হবে। সকলে মিলে সাধারণ ভাবে (যে ভাবে আমরা সাধারণত হজ্ব করে থাকি) হজ্ব করে আসলেই কি নিষ্পাপ হওয়া যাবে এবং জান্নাত অর্জন করা যাবে ? অতএব, আমাদের নবী (সঃ) যেভাবে হজ্ব করেছেন, সে পদ্ধতিতে এবং নির্ভুলভাবে হজ্ব পালন করার জন্য আপনাকে অনেক পড়াশোনা করতে হবে, অনেক তালীম নিতে হবে এবং পুরা সফরে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এক কথায়, আপনাকে আদা-জল খেয়ে লাগতে হবে। সুতরাং এতোবড় ফজীলত আপনি কিভাবে অর্জন করবেন, এটা আপনার চিন্তা করার এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা করার ব্যাপার।

(২) আমার এ পোস্ট লেখার উদ্দেশ্য হলো- হাজী সাহেবদেরকে সুচারুরূপে হজ্ব পালনের ব্যাপারে আগ্রহী ও সচেতন করে তোলা, যাতে একজন ব্যক্তি, যিনি জীবনে প্রথমবার হজ্ব করতে যাবেন বা একাধিকবার যাবেন, তিনি যাতে উপলব্ধি করতে পারেন যে, হজ্বে যাওয়ার পূর্বে তার জন্য কি কি প্রস্তুতি গ্রহণ করা অপরিহার্য।

(৩) বর্তমানে বাজারে হজ্বের উপর বাংলা ভাষায় শত শত ছোট-বড় বই পাওয়া যায়। যারা লেখাপড়া জানেন, তারা নিজেরাই এসব বই পড়ে হজ্বের নিয়ম-কানুন জেনে এবং শিখে নিতে পারেন। যারা লেখাপড়া জানেন না, তারা অভিজ্ঞ আলেমদের অথবা অভিজ্ঞ হাজী সাহেবদের নিকট থেকে তালীম নিয়ে সবকিছু শিখে নিতে পারেন। যদিও শুধু বই পড়েই হজ্বের সব কিছু বোঝা যায় না।

তাই বই পড়া ছাড়াও হজ্ব সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে আলাপ-আলোচনা করে এবং সম্ভব হলে হজ্বের ভিডিও চিত্র দেখে হজ্বের যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে।

(৪) সাবধান! সাবধান! প্রশিক্ষণ অর্থাৎ পূর্ণ প্রস্তুতি না নিয়ে হজ্ব করতে যাবেন না। ব্যাপক প্রশিক্ষণ ছাড়া হজ্ব করতে গেলে কষ্টও করবেন, টাকাও খরচ করবেন, কিন্তু বিনিময়ে জান্নাতও পাওয়া যাবে না এবং শিশুর মতো নিষ্পাপও হওয়া যাবে না।

এক কথায়, সব কিছুই বিফলে যাওয়ার আশংকা। যদিও আল্লহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। তাই আমার কথায় কেউ হতাশ হবেন না। মনে রাখবেন টাকা থাকলেই হজ্বে যাওয়া যাবে না, আল্লহ্ যদি কবুল না করেন।

(৫) এ ব্যাপারে অনেকেই হয়তো আপনাকে বলবেন যে, ‘আরে ভাই, আল্লহ্ তো নিয়ত দেখবেন। আপনার নিয়ত যদি ঠিক থাকে, তাহলে ছোট-খাট ভুল-ত্রুটির জন্য আল্লহ্ সবকিছু মাফ করে দেবেন’।

এ ধরণের কথা বিভ্রান্তিমূলক। হজ্বের নিয়ত তো অবশ্যই ঠিক হতে হবে। তাই বলে হজ্বের নিয়ম-কানুন, ধারাবাহিকতা, ফরজ/ওয়াজিব/সুন্নাত আমলগুলো যথানিয়মে, যথাসময়ে, যথাস্থানে এবং যথাযথভাবে পালন না করলে শুধু নিয়ত ঠিক থাকলেই কি হজ্ব হয়ে যাবে? 

সুতরাং এসব কথায় কান দেবেন না। বরং নিজের সাধ্যানুযায়ী প্রশিক্ষণ নেয়ার চেষ্টা-প্রচেষ্টা করুন, তাহলে আল্লহ্ আপনাকে সাহায্য করবেন। যেহেতু আল্লহ পরম করুণাময় ও ক্ষমাশীল, তাই সহীহ্ নিয়ত করে হজ্জ করলে পাস মার্ক পাওয়া যাবে। অতএব হতাশ হবেন না।

খ। মানসিক প্রস্তুতিঃ যখনই একজন মুসলমান ব্যক্তি হজ্ব করার নিয়ত করতে পারলেন, তখন সর্ব প্রথমেই ঐ ব্যক্তিকে হজ্ব করার নিয়ত করার তাওফীক দেয়ার জন্য করুণাময় আল্লহর নিকট লাখো-কোটি শুকরিয়া আদায় করতে হবে। কারণ লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে যাদের আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য থাকা সত্তেও হজ্জ করার নিয়ত করতে পারে না, অর্থাৎ তাদের মনে হজ্ব করার ইচ্ছাই জাগে না, তাই হজ্জ না করেই অনেকেই মৃত্যুবরণও করে। অতএব মনের দিক থেকে আল্লহর হুকুম পালন করার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য নিজের অন্তরের মধ্যে প্রবল তামান্নার (ইচ্ছার) সৃষ্টি করতে হবে।

অর্থাৎ হজ্ব করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকেই তার চিন্তা-চেতনায়, ধ্যানধারণায়, আচার-ব্যবহারে, কাজে-কর্মে, কথা-বার্তায়- এক কথায় জীবনের সব কিছুতেই আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তখন তাকে সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, ‘তিনি এখন থেকে আল্লহর নির্বাচিত একজন সম্মানিত মেহমান’।

সাধারণত এক ব্যক্তিকে হজ্বের ৮/৯ মাস পূর্বেই হজ্ব করার সিদ্ধান্ত নিতে পারলে উত্তম হয়। তাহলে হজ্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়াসম্ভব/সহজ হয়। সরকারের বর্তমান পলিসিতে এক ব্যক্তিকে হজ্ব করতে হলে দুই বছর পূর্বেই নিবন্ধন করতে হয়। নতুবা হজ্ব করার সুযোগই পায় না।

গ। বৈষয়িক প্রস্তুতিঃ কোনো ব্যক্তি যে কোনো কাজেই নিয়োজিত থাকুক না কেন, হজ্বের নিয়ত করার পর থেকেই তাঁকে ধীরে ধীরে সকল দুনিয়াবী কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। তিনি সরকারী/বেসরকারী চাকুরী করলে তাঁকে একদিকে ছুটির আবেদন করতে হবে, অন্যদিকে মনে প্রাণে হজ্বের প্রস্তুতি গ্রহন করতে হবে।

ব্যবসা-বাণিজ্য/কৃষি-কর্মে/অন্য কোনো পেশায় জড়িত থাকলে ধীরে ধীরে সে সব কাজ থেকেও বিরতি নিয়ে হজ্বের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। অনেকের ধারণা এই যে, মক্কা- মদীনায় গিয়ে সকলের সাথে মিলে মিশে হজ্বের সব কাজ করা যাবে। এ কথা আদৌ ঠিক নয়। যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়ে গেলে সেখানে পৌঁছে শুধু হায়-আফসোস করতে হবে- আর হজ্বের কাজ সম্পাদনে ভুল-ভ্রান্তি হতেই থাকবে। ফলে হজ্ব করেও প্রশান্তি বা মনের তৃপ্তি পাওয়া যাবে না এবং সুচারুরূপে হজ্ব না করার জন্য সম্পূর্নভাবে নিষ্পাপও হওয়া যাবে না এবং জান্নাতও অর্জন করা যাবে না।

ঘ। শারীরিক প্রস্তুতিঃ হজ্বের নিয়ত করার পর থেকেই নিজের শরীরের/স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খুবই যত্নবযন হতে হবে এবং এ জন্য সর্বদা আল্লহর সাহায্য কামনা করতে হবে, যেন তিনি আপনাকে সুস্থতা দান করেন। সুচারুরূপে উমরাহ্ ও হজ্ব পালন করা এবং মদীনা শরীফে নবী (সঃ) এর রওজা পাক যিয়ারত করা কোনো সাধারণ কাজ বা ব্যাপার নয়। সুতরাং নিজের খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা ইত্যাদির ব্যাপারে সর্বদা সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

সম্পূর্ণ সফরে, বিশেষ করে মক্কা-মদীনায় অবস্থান কালে বিভিন্ন সময়ে/স্থানে বিভিন্ন ধরণের খাদ্য দ্রব্য খেতে হয়। তাছাড়া সে দেশের আবহাওয়াও সম্পূর্ণ অন্য রকম। তাই হজ্বের সময় দেখা যায়, বহু সংখ্যক লোক এক ধরণের সর্দি-কাশিতে ভোগেন, এমনকি জ্বর, পেটের পীড়া ইত্যাদি দেখা দেয়।

অতএব সব ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং আল্লহর দয়া ও করুণা চাইতে হবে। কারণ আল্লহর সাহায্য ছাড়া কারো পক্ষে কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়। এক কথায়, হজ্জ্বের সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাতে সুস্থ থাকেন, সে জন্য আল্লহর দরবারে সর্বদা ফরিয়াদ করতে হবে এবং নিজেকে সাবধান থাকতে হবে। মনে রাখবেন, হজ্বের সকল কার্যক্রম নিজেকেই পালন করতে হবে। মক্কা-মদীনায় অবস্থানকালে এবং হজ্বের ৫/৬ দিনের অধিকাংশ আ’মল পায়ে হেঁটেই সম্পন্ন করতে হবে। সুতরাং শারীরিক সুস্থতা অতীব জরুরী। তাই এ ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url